Tnntv24.নাফিজ আশরাফ :
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্স ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ আগুনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় একশ’ সত্তরজন নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের বেশিরভাগ লুটপাটকারি ও কিছু প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক বলে জানা গেছে। বিশ ঘন্টা পরেও আগুন নেভেনি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার্স। রোববার দিবাগত রাত নয়টায় লাগা আগুন সোমবার বিকেল পাঁচটায়ও জ্বলছিল।
কারখানায় প্রবেশ পথের পাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে নিখোঁজদের নাম লিখছিলেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। এখানে কথা হয়কাজ বরপা এলাকার দিনমজুর শহীদুল ইসলামের সাথে। শহীদুল জানালেন, তার ছোট ভাই স্বপন ইসলাম, ভাগিনা সাঈদুল ইসলাম নিখোঁজ। তারা গাজী টাওয়ারের তৃতীয় তলায় কাজ করতো। রোববার রাত বারোটা পর্যন্ত তাদের ফোনে সাথে কথা হয়। তারা বারবার বলছিলো তাদের বাঁচাতে। রাতে তারা এখানে এলেও আগুনের তীব্রতায় ভেতরে ঢুকতে পারেনি। যদিও তখন শত শত মানুষ ছিলো ফ্যাক্টরির সামনে। নাতি নিরবকে (১৭) খুঁজতে এসেছিলেন সুরাইয়া। নাতির খোঁজে আহাজারি করছিলেন তিনি। তার নাতি কাজ করতো যাত্রামুড়া এলাকার নবীন কটন মিলে। যাত্রামুড়া গাজী টায়ার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। এত দূরে কেন এসেছিলো তার নাতি ? সুরাইয়া জানান, মিল্লাত নামের তার আরেক বন্ধু তাকে ডেকে এনেছিলো। মিল্লাত, নিরব দু’জনেই নিখোঁজ।জ্বলন্ত ভবনে কারখানার সামনেই দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ মোসা. রুবি। তিনি জানান, তাঁর স্বামী মো. সজিব (২৬) গত রাত নয়টা থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। সজিব উপজেলার মুড়াপাড়া গঙ্গানগর এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে। সজিব রাজমিস্ত্রীর জোগালী কাজ করতো জানিয়ে রুবি বলেন, কারখানায় লুটপাট হইতাছে শুনে সজিব কারখানায় আসে। রাত নয়টায় শেষবার কথা হয়। তখন সে কারখানায়ই ছিল। পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।একই যায়গায় বিলাপ করছিলেন রূপসী মইকূলি এলাকার মো. সজিব ভূঁইয়ার (৩২) স্ত্রী কল্পনা আক্তার। কল্পনা জানান, তার স্বামী একজন জামদানী ব্যবসায়ী। তাঁদের কারখানার শ্রমিক মো. সাদ্দাম কারখানা লুটপাটের সময় আসেন। তাঁর খোঁজে রাত ১০ টায় কারখানায় আসেন সজিব। রাত সাড়ে দশটায় সজিব মায়ের মুঠোফোনে ফোন করে তাঁকে বাঁচানোর আকুতি জানান। তারপর আর সজিবের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তাদের মতো আরো অন্তত একশ সত্তর জন নিখোঁজ বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জের উপ-সহকারি পরিচালক ফখর উদ্দিন। এই একশ সত্তর জনের আত্মীয়রা তাদের স্বজন নিখোঁজ বলে ফায়ার সার্ভিসের কাছে নাম লিখিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একজন দোকানদার জানান, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে গাজী গোলাম দস্তগীরের রিমান্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে। রুপসী বাস স্ট্যান্ডে মোস্তাফিজুর রহমান ভ‚ইয়া দীপুর লোকজন মিষ্টি বিতরণ করে। সন্ধা ছয়টার দিকে জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি কাজী মনিরের সমর্থকরা কয়েকশত মোটর সাইকেল নিয়ে মহাসড়কের একটি শো-ডাউন করে। গাজীর কুশপুত্তলিকা দাহ করে। শো-ডাউনের কিছুক্ষন পর গাজী টায়ারে লুটপাট শুরু হয়। এর আগে তিন-চারশত লোক ধারালো অস্ত্র, লাঠি সোটা নিয়ে গাজী টায়ারে হামলা চালায়। বিএনপি’র নামে বিভন্ন দিয়ে লুটপাট শুরু করে।
এসময় প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় এসময় শ্রমিকরা কাজ করছিলো। হামলাকারিদের ভয়ে শ্রমিকরা বের হয়ে যেতে পারেনি। অন্যদিকে লুটপাটকারিরা তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা থেকে মালামাল নামিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। রাত নয়টার দিকে প্রতিষ্ঠানের পেছন দিয়ে ঢোকা একদল লুটপাটকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলায় ¯স্লোগান দিতে দিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনের কারনে উপরে শ্রমিকরা ও লুটপাটকারিরা আটকে পড়ে। ঘটনা সম্পর্কে জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি ও বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান জানান, গাজী সাহেব অপরাধ করেছেন। এজন্য তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু তার ফ্যাক্টরিতে হামলা করা, আগুন লাগিয়ে দেয়া আমি সমর্থন করিনা। কারন এই ফ্যাক্টরি সবার। তিনি বলেন, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকতে গাজী সাহেব আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়েছেন। সেগুলি আমি আইনীভাবে মোকাবেলা করেছি। রাজনীতির সাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দীপু বলেন, আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো তৎপর। তাদের কাছে এখনো অস্ত্র আছে। তিনি বলেন, গাজী সাহেব গ্রেফতার হওয়ার পরে বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা আনন্দিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন নির্যাতিত ছিলো। যারা এই ফ্যাক্টরিতে আগুন দিয়েছে তারা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে তারাবো পৌর বিএনপি’র সেক্রেটারি পিন্টু চাচাসহ ওয়ার্ড বিএনপি’র নেতারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। ঠেকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই হামলা মারধরের শিকার হয়েছে। যার ভিডিও আমাদের কাছে আছে। তবে গাজী সাহেবের ফ্যক্টরিতে আগুন লাগানো আমি সমর্থন করিনা। গাজী সাহেব অপরাধ করে থাকলে তার ফ্যাক্টরি সরকার নিয়ে চালাবে। কিন্তু আগুন দিয়ে সম্পদ নষ্ট করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম জানান, স্বজনদের দাবীর প্রেক্ষিতে নিখোঁজদের প্রাথমিক এই তালিকা তৈরী করা হয়েছে। তা পুলিশকে দেয়া হবে। পুলিশ তদন্ত করে এ বিষয়ে চুড়ান্ত তথ্য জানাবে।রুপগঞ্জের রুপসিতে অবস্থিত গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একে একে বারোটি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানো শুরু করে। ১২০ জন ফায়ার ফাইটার এখানে কাজ করছে। প্রায় বিশ ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলছে। আগুন লাগা ভবন থেকে আমরা চৌদ্দ জনকে উদ্ধার করেছি। এখানে টায়ার বানানোর রাবার, প্লাস্টিকসহ নানা উপাদান ছিলো। এর মধ্যে কিছু ছিলো দাহ্য পদার্থ। যে কারণে আগুন দ্রুত ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
আগুন নেভানোর পরে আমরা পুরো ফ্যাক্টরিতে তল্লাশি চালিয়ে দেখব। এর পর আমরা নিখোঁজদের ব্যাপারে বলতে পারবো।
রূপগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) জুবায়ের হোসেন জানান, নিখোঁজদের কেউ এখনো থানায় রিপোর্ট বা জিডি করেনি। তবে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশও আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে দায়িত্ব পালন করছে।
গাজী টায়ারে কোনো শ্রমিক ছিলো না-কতৃপক্ষগাজী টায়ারে কোনো শ্রমিক ছিলো না বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির এডমিন অফিসার সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে গাজী গ্রুপের রূপগঞ্জে অবস্থিত সকল ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে। ৫ আগষ্ট সন্ধ্যা থেকে রূপসীর গাজী টায়ার এবং কর্নগোপে অবস্থিত গাজী ট্যাংক, গাজী পাম্প, গাজী ডোর, গাজী পাইপ এই সবগুলি ফ্যাক্টরিতেই দুবৃত্তরা হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করে মালামাল নিয়ে যায়। ৫ তারিখের পর থেকে আমাদের সিকিউরিটিদের ভয় দেখিয়ে লুটপাট অব্যহত ছিলো। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিএনপি নেতাদের হাতে পায়ে ধরেও লুটপাট ঠেকানো যায়নি। গত রবিবার বিকেল থেকে পুণরায় গাজী টায়ারে ৫-৭শ দুবৃত্ত লাঠি সোটা নিয়ে হামলা ও লুটপাট শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা টায়ার ফ্যাক্টরির দ্বিতীয় তলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন আগুন ধরিয়ে দেয় তখন এ ফ্যক্টরি সম্পূর্ণ বন্ধ ছিলো। আমাদের কোনো শ্রমিক ফ্যাক্টরিতে ছিলো না। শুধু আমাদের সিকিউরিটি সদস্য এটির পাহাড়ায় ছিলো। রূপগঞ্জে অবস্থিত গাজী গ্রুপের পাঁচটি কারখানায় ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মরত ছিলো। গাজী টায়ার গত ২০-২২ ঘন্টা ধরে আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়ে গেছে। এসব ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারিদের বেতন কিভাবে দেয়া হবে, তাদের কাজের কি হবে সে নিয়ে সবাই শংকায় আছে। ফ্যাক্টরিগুলি লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের কারনে এক যোগে দশহাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। #