পাকিস্তানে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠনের আলোচনার মধ্যেই বৃহস্পতিবার নিজেদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। এদিন গুঞ্জন ওঠে, সরকার গঠনে বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে পিটিআইয়ের। তবে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে এই গুঞ্জন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, কারাবন্দি ইমরানের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, তাদের সঙ্গে জোট করা যাবে না। এ জন্যই নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে তারা। পিটিআইয়ের দাবি, তারা ১৮০টি আসনে জিতেছেন। কারচুপি করে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই কারচুপির বিরুদ্ধে শনিবার দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে তারা।
এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর সে দেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আর ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, অতীতের ভুল পথ থেকে সরে এসে পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানে নির্বাচন খানিকটা স্থিতিশীলতা আনবে বলে মনে করা হয়েছিল। উল্টো পরিস্থিতি আরও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। খবর জিও নিউজ, ডন, রয়টার্স, ডি ডব্লিউর।
জোটের গুঞ্জন, পিটিআইয়ের অস্বীকার : বৃহস্পতিবার জিও নিউজের প্রতিবেদনে ঘনিষ্ঠ পিটিআই সূত্রের বরাতে দাবি করা হয়, ইমরান পিপিপির সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলেছেন। পিটিআই নেতাদের দুই দলের মধ্যে সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতেও বলেছেন। পিটিআই ও পিপিপির সরকার গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করতে বলেছেন ইমরান খান। আরও দাবি করা হয়, পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে জমিয়ত-উলেমা-ই-ইসলাম-ফজল, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি, জামায়াত-ই-ইসলামীসহ অন্য জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব দল গত নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ করছে।
পরে দলের পক্ষে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলি সাইফ জিও নিউজের প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন দাবি করেন। তিনি বলেন, ইমরান তাদের কঠোরভাবে পিএমএল-এন ও পিপিপির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় যেতে বারণ করেছেন। প্রয়োজনে ইমরান তাদের বিরোধী দলে বসতে বলেছেন, তবু ওই দুই দলের সঙ্গে জোট নয়। তাদের দাবি, ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য নয়, তারা রাজনীতি করছেন জনগণের জন্য।
প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর নাম ঘোষণা : এদিকে পিটিআই তাদের মহাসচিব ওমর আইয়ুবকে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। তাদের এই পরিকল্পনার বিষয়টি সামনে এনেছেন পিটিআই নেতা আসাদ কায়সার। রাওয়ালপিন্ডিতে আদিয়ালা কারাগারে বন্দি ইমরান খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে আসাদ কায়সার এ ঘোষণা দেন। সূত্র বলেছে, কায়সারের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য একটি কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ইমরান খান। পিটিআই নেতা কায়সারকে বলেছেন, সব সিদ্ধান্ত দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়ার জন্য। এ ছাড়া সরকার গঠনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নিতেও পরামর্শ দিয়েছেন। ইমরান খান খাইবার পাখতুনখোয়ায় সরকার গঠন করতে নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করতেও পিটিআই নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
কায়সার বলেন, তাকে নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে আসা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে জেইউআই-এফ, এএনপি ও কিউডব্লিউপির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নির্দেশ দিয়েছেন ইমরান খান। আসাদ কায়সার বলেন, ‘আমরা সবাই একটি কৌশল তৈরি করতে চাই। কারণ জনগণের ম্যান্ডেট চুরি করা হয়েছে। এবারের এই নির্বাচন আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জালিয়াতির নির্বাচন। এই নির্বাচনে ‘বিশ্বাসযোগ্যতার’ ব্যাপক ঘাটতি ছিল।
হস্তক্ষেপ চায় না পাকিস্তান, ইমরানের নজর যুক্তরাষ্ট্রে : দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মমতাজ জাহরা বেলুচ বৃহস্পতিবার বলেছেন, পাকিস্তানের নির্বাচনে বিদেশিদের পরামর্শের দরকার নেই। নিজেদের সংবিধান অনুযায়ীই সব কিছু হবে। সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ উদ্বেগের বিষয়ে এ সব কথা বলেন মমতাজ জাহরা বেলুচ।
৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগের জবাবে মমতাজ জাহরা বেলুচ বলেন, আমরা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছি। এখানে বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো পরামর্শ প্রয়োজন নেই।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের জোট সরকার গঠন প্রক্রিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
ইমরান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রকে আবার একহাত নিয়েছেন। ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলি সাইফ বলেছেন, ‘আমরা তো দেখেছি, প্রতি মেয়াদেই যুক্তরাষ্ট্র হয় একনায়কদের সমর্থন দিয়েছে, অথবা তারা সবচেয়ে দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিয়েছে। ইমরান তাদের বার্তা দিয়েছেন যে, এবার অন্তত তাদের সামনে সুযোগ এসেছে পাকিস্তানের নির্বাচন জালিয়াতির ওপর চোখ রাখার।’
পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভের ঘোষণা : সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে পিটিআই। শনিবার দেশটিতে এই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে পালনে দলটির নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গহর আলী খান এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পিটিআইয়ের এই নেতা ভোট কারচুপির অভিযোগ করেছেন। এ সময় পিটিআই নেতা গহর আলী খান নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ পালন করে আসা জামায়াত-ই-ইসলামী, জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম-ফজলসহ (জেইউআই-এফ) অন্যান্য দলগুলোকেও পাশে চান। তিনি বলেন, এই উদ্দেশ্যে আমরা সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যারা বিশ^াস করেন যে ম্যান্ডেট পরিবর্তন এবং কারচুপি হয়েছে। গহর আলী খান বলেন, পিটিআই শনিবার বিকালে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-প্রতিবাদের রেকর্ড করবে। বিক্ষোভে জনসাধারণকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
পিটিআইয়ের এই চেয়ারম্যান বলেন, এবারের এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা আমাদের ম্যান্ডেট চুরি হতে দেব না। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সঙ্গে জোট সরকার গঠনের আলোচনার তথ্য অস্বীকার করেন তিনি।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা : অস্ট্রেলিয়ান স্ট্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নির্বাচন স্থিতিশীলতা আনবে ধারণা করা হলেও পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত। ভয়াবহ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জঙ্গিবাদ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়েছে ওই বিশ্লেষণে।
একইভাবে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন গঠিত জোট সরকার দুর্বল হবে। তাই তারা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর পরিস্থিতিতে পড়বে। জঙ্গিবাদের বিস্তৃতিরও আশঙ্কা রয়েছে।