রূপগঞ্জে রাজউকের পূর্বাচল উপশহর
এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য
আট বছরে ২২ লাশ উদ্ধার
Tnntv24.শফিকুল আলম ভূইয়া , নারায়ণগঞ্জ:
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রাজউকের পূর্বাচল উপশহর এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। এলাকাটি বর্তমানে লাশের ডাম্পিং স্পটে পরিণত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও নিরাপদ স্থান হিসেবে অন্যত্র হত্যা করে পূর্বাচলে লাশ ফেলে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। গত আট বছরে এখানে ২২টি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া পূর্বাচলে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ ও মারামারিসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলছে। পূর্বাচলে এখনো সময়উপযোগী জনবসতি গড়ে না ওঠায় অপরাধীরা নির্বিঘ্নে অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আশানুরূপ না হওয়ায় অপরাধীরা অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করে নিরাপদ আচ্ছয়ে চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরেই অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা এখানে বাড়তে থাকে। পূর্বাচলের প্রত্যেকটি এলাকাই দুর্গম। পূর্বাচল উপশহরে ঘটে চলছে একের পর এক অপরাধ। পূর্বাচল উপশহর যেন এখন অপরাধীদের ‘স্বর্গরাজ্য’।
বালু,তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী পূর্বাচল উপশহরকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। পূর্বাচলের নাগরি, গোবিন্দপুর আলমপুরা পলখান, ধামছি, মাঝিপাড়া,বাগলা, চাপড়ি, রঘুরামপুর, , খাইলসা,সুলফিনা, পিংনাল, কালনি, পর্শি,হাড়ারবাড়ি, গুতিয়াবো, কালনিসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা ডাকাত আতঙ্কে থাকেন। চোরের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় গবাদী পশুর মালিকরা থাকেন আতঙ্কে।
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে গড়ে উঠা পূর্বাচল উপশহর এখন নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ।আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলা,ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, ও র্যাবের অফিস রয়েছে। শহরের ব্যস্ততা থেকে একটুখানি বিনোদনের জন্য ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসে পূর্বাচলে। দৃষ্টিনন্দন ৩০০ ফুট সড়ক এখন পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। পূর্বাচলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হরেক রকমের কয়েক হাজার দোকানপাট। গড়ে ওঠেছে শতাধিক নার্সারী। স্থান পেয়েছে দেশী-বিদেশী নানা রকমের খাবারের দোকান। নৌ-ভ্রমন আর সামুদ্রিক মাছ ও দেশী হাঁসের মাংশ পিঠাপুলি খেতে ছুটে আসেন রসনাবিলাসিরা। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্বাচলে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সন্ধার পর সময় ভাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে নীরবতা। রীতিমতো গা ছমছমে পরিবেশ।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর সকালে, অজ্ঞাত যুবকের লাশ পূর্বাচলের ১৫ নং সেক্টরের ৫৬ নং ব্রিজের লেকপাড় থেকে উদ্বার করে পুলিশ, ১৩ নভেম্বর দুপুরে নারায়ণগঞ্জের শিল্পপতি জসিম উদ্দিনের সাত টুকরো লাশ পূর্বাচলের ৫নং সেক্টরের একটি লেক থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরকীয়ার জের ধরে তাকে ঢাকার কাফরুলের বাসার বাথরুমে হত্যা করা হয়। তারপর নিরাপদ স্থান হিসাবে পূর্বাচলের একটি লেকে লাশ ফেলে রাখে। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর পূর্বাচলের ১০ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সেতুর নিচ থেকে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় মানুষের বেশ কিছু কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।
২০২৩ সালের ৭ জুলাই পূর্বাচলের ১৯নম্বর সেক্টর থেকে অজ্ঞাতনামা যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ২৪ আগস্ট পূর্বাচলের ২০নম্বর সেক্টর এলাকার একটি সবজি ক্ষেত থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০২২ সালের ১৯মে পূর্বাচলের ২৫ নম্বর সেক্টর এলাকা থেকে মজিবুর রহমানের নামের এক ব্যাক্তির লাশ ও একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্বাচলের ১০ নম্বর সেক্টর থেকে মিলন মিয়ার লাশ, একই বছরের ২৩ আগস্ট ৪ নম্বর সেক্টর থেকে ৭ মাসের নবজাতকের লাশ, ৮ অক্টোবর পূর্বাচলের ৭ নম্বর সেক্টর থেকে হৃদয় হাসানের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর পূর্বাচলের ২৬ নম্বর সেক্টর থেকে সাইফুল ইসলাম নামের এক ইজিবাইক চালকের লাশ ও অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ পূর্বাচলের ৪ নম্বর সেক্টর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্বাচলের ৮ নম্বর সেক্টর থেকে মজুর উদ্দিন নামের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০১৯ সালে পূর্বাচলের ভোলানাথপুর এলাকার কাশফুলের ঝোপ থেকে এক ধর্ষিতা তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ১৬ নভেম্বর নিখোঁজের ৪ দিন পর মাওলা নামের অটোচালকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পূর্বাচলের ১১ নম্বর সেতুর নিচ থেকে গুলিবিদ্ধ সোহাগ, শিমুল ও আজাদ নামের তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৭ নভেম্বর পূর্বাচলের ১০ নম্বর সেক্টর থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০১৭ সালের ২জুন পূর্বাচলের গুতিয়াবো এলাকা থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মারাত্মক ধরণের বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্বাচলের ১৩ নম্বর সেক্টরে ব্রিফকেসের ভেতর থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর হযরত শহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে সাজ্জাদ হোসেন নামের এক সৌদী প্রবাসীকে গাড়ি করে পূর্বাচলে নিয়ে আসা হয়। পরে তাকে জিম্মি করের তার সঙ্গে থেকে ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ ১৫লক্ষাধিক টাকা লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা।
পূর্বাচলে ছিনতাইয়ে সক্রিয় রয়েছে ৮টি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে ৪৫ জন সদস্য রয়েছে। ২০১৯ সালের ১০মে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট রোডের ছমু মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সাইফুল ইসলাম, মাহাবুর রহমান, ওবায়দুর রহমান এবং বেলায়েত হোসেনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়া ২০১৭ সালের ৩ জুন পূর্বাচল উপ-শহরের ৫নং সেক্টরের একটি খাল থেকে ৬১টি চায়না মেশিনগান, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৫টি পিস্তল, ২টি রকেট লঞ্চার, ৪২টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৪৯টি মর্টারশেল, ২টি ওয়্যারলেস সেট, ১৫২৭ রাউন্ড গুলি, ৪৪টি ম্যাগাজিন ও ৪৯টি রকেট লঞ্চার প্রজেক্টর উদ্ধার করা হয়। পূর্বাচল সুনসান হওয়ায় এখানে ডাকাতির ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
মানুষ হত্যার পর নিরাপদ স্থান হিসেবে পূর্বাচলের বিভিন্ন স্থানে নির্বিঘ্নে লাশ ফেলে রেখে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। পূর্বাচল দুপুরের পর থেকে রাত ৯/১০টা পর্যন্ত পর্যটকে মুখোরিত থাকে। এর পর সময় ভাড়ার সাথে সাথে নিরব হতে থাকে পুরো এলাকা। ৩০০ ফুট সড়কে সড়কবাতি থাকলেও পূর্বাচলের ভেতরে শাখা-উপশাখা রাস্তাগুলোতে কোনো সড়কবাতির ব্যবস্থা নেই। এ কারণে পূর্বাচলের ভেতরের রাস্তাগুলো থাকে অন্ধকার,গহিন অরন্য, নির্জন, নীরব ও সুসান। সুযোগ পেয়ে অপরাধীরাও অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। কেউ চুরি, ছিনতাই কিংবা ডাকাতি করে। কেউবা সঙ্গীয় পুরুষ পর্যটককে জিম্মি করে নারীদের উপর নির্যাতন চালায়। কেউবা অন্যত্র হত্যা করে এখানে লাশ ফেলে দেয়।
পূর্বাচলের বাঘবের গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজউকের অধীনে পূর্বাচলের জমি অধিগ্রহণ করার পর আদিবাসিন্দাদের অনেকেই অন্যত্র বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। পূর্বাচলের কোন কোন স্থানে প্লট প্রাপ্তরা ভবন নির্মাণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফাঁকা জমি পড়ে আছে। সুযোগ পেয়ে রাতে এখানে বেশিরভাগ সময় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে।
পূর্বাচলের মধুখালী গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, সন্ধ্যার পরেই অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। পূর্বাচলের প্রত্যেকটি এলাকাই দুর্গম। পূর্বাচল উপশহরে ঘটে চলছে একের পর এক অপরাধ। পূর্বাচল উপশহর যেন এখন অপরাধীদের ‘স্বর্গরাজ্য’।
পূর্বাচলের কাদিরাটেক গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া বলেন, পূর্বাচলে পুলিশের নিয়মিত টহল থাকলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। অবিলম্বে পুলিশের টহল এখানে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
রূপগঞ্জ থানা ওসি লিয়াকত আলী বলেন, জনবল সংকট থাকায় আমাদের টহল কার্যক্রমে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম বলেন, পূর্বাচলের পুলিশ ক্যাম্প পুণরায় চালু করা হবে। পুর্বাচলে শিগগিরই পুলিশের টহল বাড়ানো হবে।