রূপগঞ্জে সেচের পানির অভাবে
বোরো আবাদ ব্যাহত, ক্ষতির সম্মুখে কৃষকরা
Tnntv24. শফিকুল আলম ভুইয়া,স্টাফ রিপোর্টার রূপগঞ্জঃ
সারা দেশে বোরো ধান রোপনের ধুম পড়েছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের চিত্র দেখা দিয়েছে ভিন্ন রূপ। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সেচের পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে মাঠ। নষ্ট হচ্ছে ধানের বীজতলা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাশীনতায় প্রতিবছর হাজার হাজার মন ধান উৎপাদনে ব্যহত হচ্ছে এ এলাকায়। এ কারণে কৃষকেরা ধান আবাদে নিরুৎসাহী হয়ে পড়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়ার দাবি জানান প্রান্তিক কৃষকরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রূপগঞ্জে নারায়ণগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ নরসিংদী সেচ প্রকল্প ব্লক -১ এর আওতায় উপজেলার তারাবো পৌরসভা, কাঞ্চন পৌরসভা, মুড়াপাড়া, ভুলতা ও গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার কৃষি জমিতে সেচের পানির অভাবে দেড় সহস্রাধিক হেক্টরের অধিক কৃষি জমি শুকিয়ে গেছে। জমিতে ফাটল দেখা গেছে। কৃষকদের ধানের বীজ তলা শুকিয়ে নষ্ট হচ্ছে। অনেকে শুকনো জমিতেই হালচাষ দিয়ে পানির অপেক্ষায় রয়েছেন। পানি না পেয়ে কৃষকরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। কবে সেচের পানি পাবে সে দিনগুলো গুনছেন। এমন অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কৃষকেরা দ্রুত সেচের পানি ছাড়ার ব্যবস্থা করার দাবি জানান।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছর রূপগঞ্জে ৫ হাজার ২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার পাঁচশত হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি দুই হাজার পাঁচশত হেক্টর জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ প্রকল্পের পানি না পেয়ে কৃজি জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচ প্রকল্প-ব্লক ১ এর তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে ৯০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচ প্রকল্প ব্লক -১ নির্মাণ করা হয়।
হাটাবো দক্ষিণ বাড়ৈপাড় এলাকার কৃষক শাহ-আলম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের ঠিক মতো পানি দেয়না । আমরা কার্তিক মাসে বীজতলা প্রস্তুত করেছি। এ বীজতলা জমিতে রোপন করতে পারছিনা । পৌষ মাসে যদি সেচের পানি ছেড়ে দিতো বিঘা প্রতি ২০/২৫ মণ ধান হতো। আমাদের যে কৃষি জমিগুলো লাগাইছি পৌষ মাঘ মাসে যদি পানি পাইতাম তাহলে ধান হইবো। পানি পাইনা বিধায় জমিগুলো ফাইটা যাইতাছে।
কৃষক বাবুল মোল্লা বলেন, সরকার কৃষি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে কৃষকের ফসল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতির জন্য কৃষি জমিতে এখনো সেচের পানি ছাড়া হয়নি। এতে আমাদের কৃষি কাজ ব্যাহত হচ্ছে। জমিতে সঠিক সময়ে সেচের পানি ছাড়লে প্রতিবিঘা জমিতে ২৫/৩০ মন ধান পাইতাম। অসময়ে পানি ছাড়লে আমরা ১০/১২ মন ধানও পাইতাম না। এতে করে আমরা কৃষকরা প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্থ হই। তা-ছাড়া তারাবো পৌরসভা, গোলাকান্দাইল, ও ভুলতা এলাকার সেচ খালের মুখ পাইপ দিয়ে বন্ধ করার কারণে ফসলি জমিতে কৃষক পানি পাচ্ছেনা।
কৃষক মোতাহার হোসেন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষি জমিতে মাঘ মাসের শুরুতে সেচের পানি ছাড়ার কথা থাকলেও দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রহস্যজনক কারণে এখনো সেচের পানি ছাড়েনি। আমাদের বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পানির জন্য হাহাকার করছি। আমাদের এ হাহাকার দেখার মতো কেউ নাই। আমাদের চোখের পানিতে বুক ভাসলেও সেচের পানিতে ফসলি মাঠ ভাসে না।
কৃষক রহিম মিয়া বলেন, বোরো মৌসুম শুরু হয় মাঘ মাসের প্রথমে। আমরা পৌষ মাসে বীজতলা প্রস্তুত করে পৌষের শেষ থেকে মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহে চারা রোপন শেষ করে ফেলি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালবাহানায় সঠিক সময়ে সেচের পানি পাইনা। এখন আমাদের জমিতে নিড়ি দেওয়ার সময়। মাঘ মাসের অর্ধেক সময় চলে গেলেও আমরা ধানের চারা রোপন করতেই পারিনাই।
কৃষক ওমর আলী মিয়া বলেন, আমরা কৃষক মানুষ। কৃষি কাজ করেই আমাদের জীবন চলে। বাপ দাদারা আগে করছে এখন আমরাও কৃষি কাজ করি। আগের মতো ফলন হয়না। এ সময় আমরা বোরো ধান লাগাইতাম। এ বছর মাঘ মাসের অর্ধেক চইলা গেলেও পানির লাইগা ক্ষেত লাগাইতে পারি নাই। কেমনে বউ পোলাপান লইয়া সংসার চালামু। সরকার যদি আমগো কৃষকদের দিকে নজর দিয়া একটু সময় মতো সেচের পানি দিতো । তাইলে আমরা বউ পোলাপান লইয়া কোনো রকম দিন পার করতাম।
কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে কৃষি নির্ভরশীল দেশ। অথচ এ দেশের কৃষকরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন অজুহাতের কারণে প্রান্তিক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। একদিকে সারের উর্ধ্বগতি মূল। শ্রমিকদের মজুরি বেশি। বীজের দামও বেশি। আবারও সময় মতো মিলে না সেচের পানি। আমাদের কৃষি কাজ ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নাই। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি কৃষি কাজ টিকিয়ে রাখার জন্য সঠিক সময়ে সেচের পানি সরবরাহ করতে হবে। কীটনাশক ও সারের দাম কমিয়ে আনলে কৃষকরা কৃষি কাজ করে লাভবান হবো এবং আমরা কৃষকরা কৃষি কাজে আগ্রহ পাবো।
কৃষক সুমন ভুইয়া বলেন, পৌষ মাসে শেষের দিকে জালি পানিতে ধান রোপন করছি। এখন জমিতে সেচের পানির অভাবে ফাটল দেখা গেছে। ধান চারা শুকিয়ে গেছে। এক সপ্তাহের ভিতর পানি জমিতে না দিলে এ ধানের চারা সব মারা যাবে। ইতিমধ্যে প্রধান সেচ খালের লোহার গেইট গুলো রাতের আধারে চোরেরা নিয়ে গেছে।ঐসব জায়গার ফসলি জমিতে পানির সেচ দিতে কৃষকের কষ্ট হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসার আফরোজা সুলতানা বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে রূপগঞ্জে ৫ হাজার ২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতি মধ্যে আমরা দুই হাজার পাঁচশত হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। বাকি দুই হাজার পাঁচশত হেক্টর জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ প্রকল্পের আওতাধীন রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচের পানি না ছাড়ার কারণে আমাদের চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা প্রতিনিয়তই আমাদের কৃষি অফিসে যোগাযোগ করছেন পানি ছাড়ার বিষয়ে। ইতি মধ্যে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের কোনো রকম সহযোগিতা করছেন না। কৃষক যদি সঠিক সময়ে পানি না পায় তাহলে কৃষকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হবে ।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ রকিবুল আলম রাজিব বলেন,গত বছর সেচ খাল খননের জন্য বরাদ্দ পেয়েছি আড়াই কোটি টাকা এবার ১ কোটি টাকা আমরা সেচ খালের জন্য বরাদ্দ পেয়েছি। অল রেডি এ বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছি এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ট্রেন্ডার জটিলতার কারনে এখনো ক্যানেল ও খালগুলো খনন করা হয়নি। যে বাজেট দেওয়া হয়েছে তা খুবই সামান্য । যে খালগুলো দিয়ে বেশি কৃষক বেশি পানি পাবে সেই খালগুলো খনন করে আগামী সপ্তাহের মধ্যে পানি ছেড়ে দিবো।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, কৃষকেরা সেচের পানির বিষয়ে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে । পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে ক্যানেলগুলো রয়েছে সেখানে পানি ছাড়া হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তারা অর্থ দেরিতে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে । সে কারণে তারা খাল ও ক্যানেলগুলো পুনরায় খনন শুরু করতে পারে নাই। এ জন্যই আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি আগামী ১০ দিনের মধ্যে যেন এ পানিটা ছাড়া হয় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে যেন বোরো মৌসুমের পূর্বেই টাকাটা ছাড় করা হয় যাতে করে কৃষকরা পানির সুফলটা ভোগ করতে পারে।