মহান আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ যেমন তার পার্থিব প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা আবিষ্কার করতে পারে, তেমনি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি, ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আখিরাতের সফলতা-ব্যর্থতার জ্ঞানও অর্জন করতে পারে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর এ যোগ্যতা নেই। এর মর্যাদা অনেক বেশি।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’ (মুসলিম : ২৬৯৯)। আরেক হাদিসে আছে, ‘আল্লাহ যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান, তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন’ (বুখারি : ৭১)। শিক্ষার বিস্তারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন শিক্ষক। হাদিসে রাসুল (সা.) নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। শিক্ষকের অর্জন ও পুরস্কার যেমন বড়, তেমনি তার দায়িত্বও অনেক ভারি। বলা যায়, শিক্ষকতা পেশা একটি সদকায়ে জারিয়া। তাই এই পেশা বিশেষ সচেতনতার দাবি রাখে।
কথা ও কাজের মিল থাকা : কথা ও কাজের মিল থাকা একজন আদর্শ শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য। নবী (সা.) কথা-কাজের মিল না থাকা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমি এমন কিছু মানুষের সামনে দিয়ে অতিক্রম করি আগুনের কাঁচি দিয়ে যাদের ঠোঁট কাটা হচ্ছে। নবী (সা.) বলেন, আমি বললাম, এরা কারা? তারা (ফেরেশতারা) বললেন, দুনিয়ার ওই সব বক্তা, যারা মানুষকে নেক কাজের নির্দেশ করত, অথচ নিজেরা এটা ভুলে থাকত।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩/১২১)
একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা : একনিষ্ঠতার গুণ একজন শিক্ষকের জন্য মণি-মুক্তার মতো মহা মূল্যবান সম্পদ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম’ (সুরা বায়্যিনাহ : ৫)। আর একনিষ্ঠতা ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। একনিষ্ঠতা না থাকলে মানুষ শিরকে পর্যন্ত লিপ্ত হয়ে যায়। আর শিক্ষা-দীক্ষার জন্য তো একনিষ্ঠতা অন্যতম নেক কাজ।
দায়িত্বের প্রতি যত্নবান হওয়া : ছাত্রদের যোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া, প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া নিয়মাবলি যথাযথ পালন করা একজন শিক্ষকের মূল দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ ভালোবাসেন, যখন তোমাদের কেউ কোনো কাজ করে, সে যেন তা খুব ভালোমতো করে’ (মাজমাউজ জাওয়াইদ : ৬৪৬০)। আর এ ভালোমতো দায়িত্ব সম্পাদন দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা ছাড়া কখনোই সম্ভব হবে না।
উত্তম চরিত্র : উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়া শিক্ষক হতে হলে অবশ্যই দরকার। আর সততা তো শিক্ষকের মুকুট। এটা হারালে মানুষের আস্থা ও সম্মান তার থেকে উঠে যাবে। এজন্য একজন শিক্ষকের স্পষ্টভাষী ও সত্যবাদী হওয়া একান্ত কর্তব্য। তিনি কাউকে ধোঁকা দেবেন না। চক্রান্ত করবেন না। লোক দেখানোর জন্য কিছু করবেন না। সত্য বলবেন। সত্যকে ভালোবাসবেন। ভুল হলে স্বীকার করবেন। খুশিমনে তা শুধরে নিতে সচেষ্ট হবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’ (সুরা তওবা : ১১৯)
কোমল আচরণ : শিক্ষক হবেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। হবেন সহনশীল। দয়ার্দ্র। কঠোরতা করবেন না। তাই বলে অতিশয় শিথিলতা প্রদর্শনের কথা বলা হচ্ছে না। সর্বাবস্থায় মধ্যপন্থা অবলম্বনই উত্তম। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, যাকে আমার উম্মতের কোনো কিছুর দায়িত্ব দেওয়া হয়, অতঃপর সে তাদের প্রতি কঠোরতা করে, তাহলে আমিও তাদের প্রতি কঠোরতা করব। আর যাকে আমার উম্মতের কোনো কিছুর দায়িত্ব দেওয়া হয়, আর সে তাদের প্রতি কোমল আচরণ করে, তাহলে আমিও তাদের প্রতি কোমল আচরণ করব।’ (মুসলিম :১৮২২৮)
নম্রতা ও সহনশীলতা : নম্রতা প্রশংসিত একটি গুণ। একজন শিক্ষকের তা খুব প্রয়োজন। এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মর্যাদা ও সম্মান বাড়ে বৈ কমে না। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে কেউ নম্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মর্যাদা উন্নীত করে দেন’ (মুসলিম : ২৫৮৮)। সত্য অস্বীকার করা, ইলম নিয়ে আত্মগরিমা করা, সাথী-সঙ্গী ও ছাত্রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাও অহংকারের মধ্যে শামিল।
ধৈর্য ও ক্রোধ সংবরণ : এ দুটি গুণ একজন শিক্ষককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। আর এ দুটি গুণের অভাবে অনেক সময় পেরেশানিতে ভুগতে হয়। ধৈর্য ধারণের নির্দেশ করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর ধৈর্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ পুণ্যবানদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না’ (সুরা হুদ : ১১৫)। আর রাগ সংবরণ করা সম্পর্কে নবী (সা.) বলেছেন, ‘বীর সে নয়, যে কুস্তিতে বিজয় লাভ করে, বীর তো সে, যে নিজেকে রাগের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে’ (বুখারি : ৫৬৪৯)।
ইনসাফ ও সমতা : সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করে চলতে হবে। হজরত মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘শিক্ষক যদি বাচ্চাদের সঙ্গে সমতার আচরণ না করে, তাহলে সে জালেম বলে গণ্য হবে’ (আল-আদাবুশ-শারইয়্যাহ, ইবনে মুফলিহ : ১/১১৮)। দুর্বল ছাত্রদের অবহেলা করা, তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা এবং নসিহত করতে কার্পণ্য করা এ সবই জুলুমের মধ্যে পড়ে।
কথাবার্তায় সংযম অবলম্বন : শিক্ষকদের জন্য ছাত্রদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলা। অশ্লীল কথা না বলা। গালি না দেওয়া। তাদের সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ না করা। কারণ এগুলো করলে ছাত্রদের মন ভেঙে যায়। এর খারাপ পরিণতি সম্পর্কে রাসুল (সা.) হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি কাজ, আর তাকে হত্যা করা কুফুরি।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪১৭৮)