মর্যাদা রক্ষাকরে জেলা প্রশাসক
মাহমুদুল হকের বিদায়
সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে বিদায় নিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। খুব কম সংখ্যক লোকই পারে এমন মর্যাদা রক্ষার মত কাজ। নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব পালনকারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক তার কর্মদক্ষতা, মানবিকতা ও সাহসিকতার জন্য জেলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি তার পেশাদারিত্ব এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তার কাজের জন্য তাকে স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের রোষানলেও পড়তে হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনো নতজানু হননি।
জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নারায়ণগঞ্জের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দিতে মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেক্টরে অস্থিরতার মধ্যে তিনি ঠান্ডা মাথায়, সুকৌশলী সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন জটিল হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। শূন্য থানা থেকে চুরি হওয়া অস্ত্র উদ্ধার এবং পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনাসহ তার নেতৃত্বে জেলা ফিরে পায় স্থিতিশীলতা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর যেখানে অন্যান্য জেলার ডিসিরা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, মাহমুদুল হক তা দক্ষতার সাথে সামলান। তিনি রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে বিশৃঙ্খলা রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন ।
মাহমুদুল হকের দায়িত্বকালে সাধারণ মানুষ সরাসরি তার সাথে দেখা করে সমস্যার কথা বলতে পেরেছে। তিনি ধৈর্য ধরে সকলের কথা শুনেছেন এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার আগে, জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করা ছিল সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। তিনি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য নিজের দরজা খুলে দেন, যা তাকে জনগণের ডিসি হিসেবে পরিচিত করে।
নারায়ণগঞ্জে যোগদানের পরই তিনি আলোচনায় আসেন, তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের একটি সামাজিক সমাবেশে উপস্থিত না হওয়ায়। পরবর্তী সময়ে ওসমান পরিবারের পক্ষ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স চাওয়া হলে তিনি তা মঞ্জুর করেননি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে তিনি শামীম ও সেলিম ওসমানের বিরাগভাজন হন। নির্বাচনের দিন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে ফতুল্লার একটি ভোটকেন্দ্রে শামীম ওসমানের পক্ষে নৌকায় জাল ভোট দিতে গেলে তার দুই কর্মীকে আটক এবং দুই বছরের জেল দেন তিনি।
জেলা প্রশাসনের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত শাখা হিসেবে পরিচিত ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় আমূল পরিবর্তন আনেন তিনি। একটি ঘটনায় ৪২ লাখ টাকা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেন এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার সময়ে বহু মানুষ জমির ন্যায্য মূল্য এবং তাদের দীর্ঘদিনের আটকে থাকা সমস্যার সমাধান পেয়েছে।নারায়ণগঞ্জের বিশৃঙ্খল পরিবহন খাত এবং ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে তার উদ্যোগ প্রশংসিত হয়। তিনি কেবল হুঁশিয়ারি দিয়ে নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে শহরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। যদিও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী শহরের পরিবেশ পরিস্থিতি একবারে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়।
অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলেও নারায়ণগঞ্জে তিনি মালিক ও শ্রমিকদের সাথে নিয়মিত আলোচনা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তার সক্রিয় ভূমিকার ফলে জেলার শিল্প খাত স্থিতিশীল থাকে।
মোহাম্মদ মাহমুদুল হকের দায়িত্ব পালনকালে নারায়ণগঞ্জ একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একজন পেশাদার, দক্ষ এবং মানবিক জেলা প্রশাসক হিসেবে তার কাজের জন্য জেলা তাকে দীর্ঘদিন স্মরণে রাখবে।