আন্তর্বর্তী সরকার ত্বকী হত্যার
বিচার শুরু না করায় ক্ষোভ
ত্বকী হত্যার ১২ বছর! নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। শুক্রবার বিকেলে এক সমাবেশে বক্তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ স্বার্থে ত্বকী হত্যার তদন্ত ও বিচারকাজ বন্ধ রেখেছিল। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের উৎখাত হওয়ার ৭ মাস পরেও অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু করতে পারেনি।
বক্তব্য রাখছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
বর্তমান সরকার এই বিচারকাজ শুরু করতে না পারার পেছনে কারণ কী, প্রশ্ন রাখেন বক্তারা।
চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ আয়োজিত এই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি, সদস্য সচিব হালিম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক, খেলাঘর আসরের সাবেক সভাপতি রথীন চক্রবর্তী, সিপিবির জেলা সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন, ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন, আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর সভাপতি নূরউদ্দিন আহমদ, বাসদের সদস্য সচিব আবু নাঈম খান, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম কাজল, সাবেক সভাপতি জাহিদুল হক দিপু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি মাহমুদ হোসেন, খেলাঘর আসরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম প্রমুখ।
সমাবেশে সঞ্চালনা করেন সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল।
আনু মুহাম্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ওই সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে আটকে থাকা হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার গত সাত মাসেও সম্পন্ন করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। এতে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
ত্বকী হত্যার বিচার দ্রুত শুরুর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “কারা ত্বকীকে হত্যা করেছে এইটা আপনারা সবাই জানেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজে কীভাবে এই হত্যাকারীদের রক্ষা করেছেন তাও জানেন। তার প্রশ্রয়ে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাফিয়াতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। র্যাব-পুলিশের মধ্যে খুনিদের পৃষ্ঠপোষক তৈরি করেছিলেন, ক্রসফায়ারের মতো ভয়ঙ্কর নারকিয় অবস্থা তৈরি করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি নারায়ণগঞ্জে ত্বকীর হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, তাদের রক্ষা করেছিলেন। তার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতের কারণে ত্বকী হত্যার বিচার হয় নাই। শুধু ত্বকী নয়, গুম, খুনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত এই বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে।”
ত্বকীর খুনিরা কীভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং আনন্দে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেÑ এ প্রশ্নও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কাছে রাখেন আনু মুহাম্মদ।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যাশা ছিল সন্ত্রাসমুক্ত, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। সাতমাস পার হয়েছে। প্রত্যাশা অনেক উচুতে ছিল। কিন্তু সেই প্রত্যাশা আস্তে আস্তে কমে গিয়ে আবার একটা হতাশা তৈরি হচ্ছে। হতাশা মানেই মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে তা না। হতাশাও অনেক সময় সক্রিয়তার বড় কারণ হয়।”
তিনি আরও বলেন, “পরিবর্তনের চিহ্ন রাখার জন্য এই সরকারের প্রথম কাজ ছিল, ত্বকী, তনু, সাগর-রুনি, মুনিয়ার মতো যে খুনগুলোর বিচারের জন্য মানুষ অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল সেগুলো নিশ্চিত করা। এই বিচারগুলো খুব দ্রুত সম্পন্ন করা তাদের জন্য খুব কঠিন ছিল না।”
গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির উত্থান ও ঐক্যবদ্ধ সক্রিয়তা ছাড়া এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়া সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রফিউর রাব্বি বলেন, “ত্বকী হত্যার বিচার হাসিনা করেনি। কারণ, তার মাফিয়ারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ত্বকী হত্যা নিয়ে কথা বলেছিলেন, র্যাব কিছু কাজও করলো। ছয়জনকে তারা গ্রেপ্তার করেছিল, একজনের জবানবন্দিও নিয়েছিল। কিন্তু এরপর আর কিছু এগোয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “ত্বকী হত্যার এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে তদন্ত প্রায় শেষ করে ফেলার কথা জানায়। একটি খসড়া চার্জশিটও তারা তৈরি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই চার্জশিট পূর্ণাঙ্গ করছে না তদন্তকারী সংস্থাটি।”
ত্বকী হত্যায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তার পরিবারের লোকজন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আদালত তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারির সমালোচনা করেন নিহত ত্বকীর পিতা।
বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দায়িত্ব নেওয়ার পর সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করার ওয়াদা করলেও তারা তা রাখেননি। ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। রাজপথ ছেড়ে তারা যাবেন না। তারা অনতিবিলম্বে সকল হত্যাকারীদের নাম সংযুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একটি পাঠাগারের সামনে থেকে অপহরণ হয় তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। দুইদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা কুমুদিনী খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যরা সম্পৃক্ত আছেন বলে অভিযোগ ত্বকীর পরিবারের। ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জে গত ১২ বছর ধরে প্রতিমাসে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।