জানেন, আমরা মেয়েরা বাবার অপদস্থ
হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছি না
Tnntv24.অনলাইন ডেক্স:
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী চৌধুরী (টিএসি) উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই করানোর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে তাঁর ছোট কন্যা ভাবনা আচার্য ফেজবুকে চোখ ভেঁজানো প্রতিক্রিয়া লিখেছেন;‘…জানেন, আমরা মেয়েরা বাবার অপদস্থ হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছি না। ভাবুন উনি শিক্ষক নয় শুধু, উনি আমাদের বাবা। আপনার বাবার সাথে এমন হলে আপনার কেমন লাগবে বলুন!’
বাবাকে পদত্যাগপত্রে সই করানোর ঘটনার ভিডিও যুক্ত করে বৃহস্পতিবার ( ১৭ এপ্রিয় ) বেলা সোয়া দুইটার দিকে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। ফেসবুকে তাঁর এই স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়েছে। আজ শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টা পর্যন্ত ফেসবুকে ৩ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ ভিডিওটি দেখেছেন, শেয়ার করেছেন প্রায় ১ হাজার ৯০০ মানুষ।
কান্তি লাল আচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাটি ঘটে গত বুধবার। অভিযোগ উঠেছে, ওই দিন স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিদ্যালয়ে মিছিল নিয়ে গিয়ে কান্তি লাল আচার্যকে ঘেরাওয়ের পর জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নিয়েছেন।
কান্তি লাল আচার্যের তিন মেয়ের মধ্যে ভাবনা আচার্য সবার ছোট। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। ভাবনা আচার্য ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আমার বাবা কান্তি লাল আচার্য ৩৫ বছর ধরে ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। আমার বাবাকে গতকাল (বুধবার) কোনোরকম প্রমাণিত অভিযোগ ছাড়া বলপূর্বক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ করানো হয়। আমার বাবার কী অপরাধ, কী সমস্যা, কিছু বলা হয়নি।’
ভাবনা আচার্য লেখেন, ‘জানেন, স্কুলে ঝামেলা হওয়ার আগে বাবাকে মানা করা হয় স্কুলে যেতে। বলছিল, স্কুলে গেলে অপমান হতে হবে। বাবা সেই কথার উত্তরে বলেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমার কোনো অপরাধ নেই। আমাকে পদ থেকে সরে যেতে বললে নির্দ্বিধায় আমি সরে যাব। তবুও আমি স্কুলে যাব। আমি কেন পালিয়ে বেড়াব। কেউ আমার অপরাধের প্রমাণ আনতে পারলে আনুক।’
বলপূর্বক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করানো হয়
ভাবনা আচার্য আরও লেখেন, ‘বাবাকে পদত্যাগ করানোর আগে স্কুলে ককটেল ফাটানো হচ্ছিল। আমার বাবা তখনো নির্ভীক। জোর করে সাইন করতে বলছিল এমন একটি কাগজে, যেখানে লেখা ছিল-দুর্নীতির অভিযোগে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি। বাবা নির্ভয়ে বলেছিল, আমি দুর্নীতি করিনি, এই পেজে আমি সাইন করব না। এমনিতেই পদত্যাগ করছি। সেই সময় বাবাকে একদল মারতে যায়। পরবর্তীতে, আরেকটি কাগজে লেখা হয়—ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি।’
বাবাকে অপদস্থ করার এ ঘটনায় হতাশার কথা জানিয়ে ভাবনা লেখেন, ‘কী সুন্দর তাই না! আমার বাবা কত মানুষকে ঘরে রেখে পড়িয়েছেন, কত মানুষকে টাকা ছাড়া পড়িয়েছেন, কত মানুষের ফি মওকুফ করেছেন। আজ একজন শিক্ষকের এই পরিণতি!’
এ ঘটনার পর বাবা অসুস্থ হয়ে গেছেন উল্লেখ করে ভাবনা লেখেন, ‘একজন শিক্ষকের এই অপমান! পৃথিবীতে একমাত্র হীন জাতি আমরা, যারা পদে পদে শিক্ষকদের টার্গেট করে এই অপমানজনক পরিস্থিতি উপহার দিচ্ছি।’
তাঁর এই স্ট্যাটাসে সকাল সোয়া ১০টা পর্যন্ত কমেন্ট করেছেন ১৩৯ জন। তাঁদের প্রায় সবাই এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিচার দাবি করেছেন। এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন অনেকে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের পরিচালনায় গঠিত অ্যাডহক কমিটির সভাপতির পদ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। কমিটির বর্তমান সভাপতি জামায়াত–সমর্থিত মহিউদ্দিন আহমেদ। বুধবার প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগপত্রে সই করানোর সময় মহিউদ্দিন আহমেদও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকেও অনেকটা জিম্মি করে রাখা হয়। তাঁর এক আত্মীয়ের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানোর পর ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আনোয়ারের গাড়িতে করে কান্তি লাল আচার্যকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।
ঘটনার পর ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ার বলেন, কান্তি লাল আচার্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁর পদত্যাগ দাবি করে মিছিল-সমাবেশ করেন। উত্তেজিত জনতার চাপে প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনার তদন্তে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছেন। আগামী চার কর্মদিবসের মধ্যে ঘটনাটি তদন্ত করে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। ঘটনার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য বলেন, বিদ্যালয়ের ঘটনার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তাঁকে নিয়ে তাঁর পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন।